ভাসানচর এখন আধুনিক বাসযোগ্য শহর
বিশেষ প্রতিবেদক ::
ভাসানচর, নোয়াখালীর হাতিয়ার জরঈশ্বর ইউনিয়নের একটি দ্বীপ ভাসানচর। তিন দশক ধরে ভাসানচরে মানুষের যাতায়াত। হাতিয়া থেকে এর দূরত্ব ১৩ দশমিক ২ নটিক্যাল মাইল।
ঠেঙ্গারচর এবং জালিয়ারচরের সমন্বয়ে এই চর গঠিত। চলতি দশকে নোয়াখালীর সুবর্ণচর, হাতিয়া ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থেকে প্রচুর মানুষ দ্বীপটিতে যায়। তাদের বেশিরভাগই জেলে ও রাখাল। এক দশক আগেও ভাসানচরে ছিলো জল দস্যূদের নিরাপদ আবাস। দস্যূরা জেলে-রাখালদের উপার্জিত অর্থ ও সম্পদ ছিনিয়ে নেয়ার পাশাপাশি হত্যা-নির্যাতন করত।
বর্তমানে ভাসানচর দেশতো বটে, বিশ্বব্যাপী ভাসানচরের পরিচিতি রয়েছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একাংশকে এই চরে স্থানান্তরের জন্য বেছে নিয়েছে সরকার।
রোহিঙ্গাদের জন্য পরিকল্পিত আবাসন, উন্নতমানের রাস্তাঘাট, নিরবচ্ছিন্ন নিজস্ব বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসাসেবা, ফোরজি নেটওয়ার্ক, নিরাপত্তায় সিসিটিভি স্থাপনের ফলে পাল্টে গেছে চরটির সামগ্রিক চিত্র।
পর্যাপ্ত সুপেয় পানি, পরিবেশসম্মত স্যানিটেশন সুবিধা, খাদ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থা ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ-সব মিলিয়ে ভাসানচর এখন যেন আধুনিক এক পরিকল্পিত নগরী।
ভাসানচরের সঙ্গে পরিচিত এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই স্থানটি ছিল অপরাধীদের অভয়ারণ্য। সমুদ্রে মাছ ধরা জেলেরা এখানে এসে বিশ্রাম নিতেন।
হাতিয়া, রামগতির ও সন্দ্বীপের বেশ কয়েকজন ব্যক্তি চলতি দশকের শুরুতে এখানে মহিষ পালনের জন্য রাখালদের নিয়ে আসেন। কিন্তু প্রায়ই তাদের জলদস্যুদের লুটতরাজের মুখে পড়তে হতো।
জলদস্যুদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। যাদের মধ্যে ছিলে জেল ও রাখাল বেশি। এমনকি সারা বছর ১ লাখ টাকা চুক্তিতে কাজ করেও অনেক রাখাল সেই টাকা বুঝে পাননি দস্যুদের কারণে। সরকার এই স্থানটিতেই রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত হয়।
৩ হাজার ১০০ কোটি টাকায় ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় প্রকল্প ‘আশ্রয়ণ-৩’। প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে সাময়িকভাবে স্থানান্তরের জন্য প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছে।
প্রকল্পটি মূলত ক্লাস্টার হাউস, শেল্টার স্টেশন বা গুচ্ছগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এই মেগা প্রকল্পটি নির্মাণ, বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনা করছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রশাসনিক বিষয়টি নজরদারি করছে। জানতে চাইলে ভাসানচর আবাসন প্রকল্পের পরিচালক নৌবাহিনীর কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জানান, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে পরিকল্পিতভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
এখানে যারা থাকবেন তারা সব ধরনের মানসম্মত নাগরিক সুবিধা পাবেন। পুরো প্রকল্পটি আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে করা হয়েছে। শিগগির রোহিঙ্গারা এখানে আসবে বলে আশা করছি। বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের সন্তানদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্যও এতে রয়েছে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। তাদের খেলাধুলার জন্য রয়েছে দুটি খেলার মাঠ।
ভাসানচর ঘুরে দেখা যায়, পরিকল্পিত নকশায় ভূমি থেকে প্রতিটি ক্লাস্টার হাউস ৪ ফুট উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি হাউসে ১২টি গৃহ এবং প্রতিটি গৃহে ১৬টি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি রুমে পরিবারের ৪ জন করে থাকতে পারবেন। প্রকল্পে থাকা এমন ১২০টি ক্লাস্টার হাউস বা গুচ্ছগ্রামে ১ হাজার ৪৪০টি ঘর এবং ১২০টি সাইক্লোন শেল্টার স্টেশন রয়েছে। শেল্টার স্টেশনগুলো এমনভাবে স্টিল, কংক্রিট এবং কম্পোজিট স্ট্রাকচারে তৈরি যা ২৬০ কিলোমিটার গতির ঘূর্ণিঝড় সহ্য করতে সক্ষম। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় প্রতিটি শেল্টার স্টেশনে ১ হাজার করে ১২০টি সেন্টারে ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে।
এ ছাড়া প্রতিটি সাইক্লোন শেল্টারের নিচতলায় আশ্রয় নিতে পারবে ২শ’ করে গবাদি পশু। এ ছাড়া এখানে ২৪ ঘণ্টাই এখানে বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে।
১ মেগাওয়াট হাইব্রিড সোলার প্যানেল, প্রয়োজনীয় পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন লাইন, একটি ১ মেগাওয়াট জেনারেটর, দুটি ৫০০ কিলোওয়াটসহ মোট ৩টি ডিজেল জেনারেটর স্থাপন করা হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় ভাসানচরে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহের জন্য ৫০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন ২টি ফুয়েল ট্যাংক নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে।কেন্দ্রীয়ভাবে করা হয়েছে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট। নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের জন্য রয়েছে ফোরজি নেটওয়ার্ক।
রাতে ভাসানচর ঘুরলে মনে হতে পারে এটি ইউরোপের আধুনিক কোনো শহর। রোববার রাতে দেখা যায়, দৃষ্টিনন্দন সড়ক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল, এনজিও কর্মীদের চলাফেরায় অনেকটাই জমে উঠেছে ভাসানচর। ইউকেভিত্তিক সংস্থা এমডিএম আর্কিটেক্টস দ্বারা এর অভ্যন্তরীণ স্থাপনাসমূহ নির্মাণের পরামর্শ নেয়া হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়েছে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) স্ট্যান্ডার্ড। ফলে শুধু রোহিঙ্গা আশ্রয়ের জন্যই নয়, নান্দনিকতার ফলে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এখানে।
প্রকল্পটিতে ৯১.৫ ফুট উচ্চতা ও ১৪ নটিকেল মাইল পর্যন্ত নেভিগেশন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ১টি লাইটহাউস নির্মাণ করা হয়েছে। ব্যারাক হাউসসমূহে অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে নির্মিত পুকুরের পানি ও অগ্নিনির্বাপণের কাজে ব্যবহার করা যাবে। এ ছাড়াও স্থায়ী ফায়ার স্টেশনের জন্য প্রকল্প এলাকায় ১ একর জমির স্থান সংকুলান রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া প্রকল্পটিতে প্রতিটি ব্যারাক ঘর পৃথক সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি শেল্টারে ৫ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পৃথক সোলার সেলের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে। যার মাধ্যমে প্রতিটি শেল্টার স্টেশন আলোকিত রাখার পাশাপাশি সৌর পাম্প ব্যবহার করে পানি তোলা যাবে। মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রকল্পে সেপটিক ট্যাংক ও সোকওয়েল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এর বাইরেও প্রতিটি ক্লাস্টারে স্বল্প পরিসরে খেলাধুলার ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে মসজিদ, ২টি ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল এবং চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক। বাসিন্দাদের কারও মৃত্যু হলে সৎকার ও কবর দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা রাখা হয়েছে।
ভাসানচরে স্থানান্তরের প্রথম ধাপে ৬শ’ রোহিঙ্গা পরিবারকে সেখানে নেয়া হবে। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ ৩৪টি ক্যাম্প থেকে স্বেচ্ছায় যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যেতে উখিয়া কলেজ মাঠে অস্থায়ী ট্রানজিট পয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে। মাঠে একাধিক কাপড়ের প্যান্ডেল ও বুথ তৈরি করা হয়েছে। শিগগির তাদের উখিয়া কলেজ মাঠ থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু হতে পারে।
এ জন্য প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যবস্থা ও খাদ্যসামগ্রী মজুদ করা হয়েছে। এর আগে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম ঘিরে বঙ্গোপসাগরের এ দ্বীপে যায় ২২টি এনজিও প্রতিনিধি দল।