করোনাকালে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, বন্যা জনজীবনে দূর্ভোগ চরমে

Corona.jpg

বিশেষ প্রতিবেদক :

চলছে করোনাকাল। কর্মহীন লক্ষ লক্ষ মানুষ। আবার অনেকে চাকুরী আছে, বেতন নেই। আবার কেউ কেউ বেতন পাচ্ছেন অর্ধেক। চলছে না বাসা ভাড়া, দেনন্দিন বাজার খরচ। অনিশ্চয়তায় জীবন। ফলে অনেক বছরের শহর ছাড়ছে হাজার হাজার শহরবাসী।

চলছে করোনা মহামারি। দেশের নেক জলায় বন্যা। পাশাপাশি অতি বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা ।তার ওপর সময়টা এখন ডেঙ্গুরও সময় চলছে।। এ সময় করোনাভাইরাস, ডেঙ্গু এমনকি চিকুনগুনিয়ার জীবাণুও পাওয়া যেতে পারে একই ব্যক্তির দেহে। এ পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. মোমিনুর রহমান মামুন।

করোনায় কাঁপছে বিশ্ব। আমাদের দেশও তার বাইরে নেই। এর মধ্যে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদিতে আক্রান্ত হওয়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। সমস্যা হলো—কভিড, ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া—যাই হোক না কেন, লক্ষণগুলো অনেকাংশে একই ধরনের, যাতে অনেকে বিভ্রান্ত হন।

কভিড-১৯
কভিড-১৯ হলো করোনাভাইরাসজনিত একটা রোগ। এটা সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। করোনা আক্রান্ত রোগীর হাঁচি, কাশি, থুতুর সঙ্গে যে জলীয় ক্ষুদ্র কণা বের হয় তাতে সুস্থ মানুষের দেহে এই রোগ ছড়াতে পারে।

লক্ষণ
► জ্বর, ► গলা ব্যথা, ► সর্দি, ► শুকনা কাশি, ► ঘ্রাণশক্তি লোপ পাওয়া, ► মুখে স্বাদ না পাওয়া, ► কোনো কোনো ক্ষেত্রে অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়ে শ্বাসকষ্ট হওয়া,  ► অনেক ক্ষেত্রে রোগটি উপসর্গহীন থাকে, যাকে বলে ‘অ্যাসিম্পটোমেটিক’। তখন ওই ব্যক্তি থেকে অন্যজনের শরীরে কভিড ছড়াতে পারে।

করণীয় বা চিকিৎসা
► আক্রান্ত ও সুস্থ সবাইকে মাস্ক ব্যবহার করা। তিন থেকে ছয় ফুট নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এতে শূন্য শতাংশও ঝুঁকি থাকে না। ► হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলা।, ► কারো উপসর্গ দেখা দিলে কভিড টেস্ট করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। এ ক্ষেত্রে পজিটিভ হলে হোম আইসোলেশন বা হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। তবে বেশির ভাগ রোগীই (৮০ শতাংশের ওপর) হোম আইসোলেশনে থেকেই ভালো হয়ে যাচ্ছে। ► কেউ আক্রান্ত হয়ে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা নিতে হবে।

ডেঙ্গু
এটিও একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যার বাহক এডিস মশা। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে কয়েক দিনের মধ্যেই সেই ব্যক্তি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। বেশির ভাগ ডেঙ্গু জ্বর ছয়-সাত দিনের মধ্যে সেরে যায়। তবে ডেঙ্গু হেমোরেজিক বা রক্তক্ষরণজনিত এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে ভয়াবহতা বেশি। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না নিলে ঝুঁকি থাকে।

লক্ষণ
► জ্বর (সাধারণত ১০১ সে.-এর ওপরে থাকে), ► মাংশপেশিতে ব্যথা, শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখ লাল হওয়া ও চোখের পেছনে ব্যথা, অরুচি বা বমি বমি ভাব ইত্যাদি। ► বিভিন্ন স্থানে হামের মতো র‌্যাশ (লালচে দানা) হতে পারে। ► হেমোরেজিক বা রক্তক্ষরণজনিত ডেঙ্গু হলে দাঁত ও মাড়ির গোড়া থেকে, নাক দিয়ে বা বমির সঙ্গে, পায়ুপথসহ শরীরের বিভিন্ন স্থান দিয়ে রক্তপাত হতে পারে। করণীয় বা চিকিৎসা। ► রোগীকে পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। ► যথেষ্ট পরিমাণ পানি বা তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে। ► নির্ধারিত কোনো চিকিৎসা নেই। জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ ছাড়া ব্যথানাশক অ্যাসপিরিন বা ক্লোফেনাকজাতীয় ওষুধ সেবন করা উচিত নয়। এতে রক্তক্ষরণ হতে পারে। ► রক্তক্ষরণের লক্ষণ দেখামাত্র হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। ► কারো ডেঙ্গু হলে মশারি ব্যবহার করে রোগীকে আলাদা রাখুন। এতে অন্যরাও রক্ষা পাবে। ► ডেঙ্গু প্রতিরোধে যেকোনোভাবেই হোক এডিস মশা দমন করতে হবে। এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা, বিশেষ করে বাসাবাড়ির আশপাশে তিন দিনের বেশি স্বচ্ছ পানি জমিয়ে না রাখা উচিত। মোট কথা মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে করণীয় সব কিছু করতে হবে।

চিকুনগুনিয়া
এটি ছড়ায় স্ত্রীজাতীয় এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস মশার কামড়ের মাধ্যমে। চিকুনগুনিয়া হলে দেহের একাধিক জয়েন্টে আক্রমণ করতে পারে। তবে এটি একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ।

লক্ষণ
► চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ অনেকটা ডেঙ্গুর মতোই, তবে দেহের তাপমাত্রা একটু বেশি (উচ্চ তাপমাত্রা) থাকে। সাধারণত দুই থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া থাকে এবং একসময় নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়। ► হাত বা পায়ের আঙুল, গোড়ালি, কবজি, মেরুদণ্ড বা অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথার সঙ্গে তা ফুলেও যেতে পারে। জ্বর সেরে যাওয়ার পরও ব্যথা বেশ কিছুদিন থাকতে পারে। ► তীব্র মাথা ব্যথা, মাংসপেশির ব্যথা ও দুর্বলতা দেখা দেয়। ► জ্বর কমে যাওয়ার পর ৭০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে তিন সপ্তাহের মধ্যে ব্যথা চলে যায়। বাকি ৩০ শতাংশের ব্যথা বেশ কিছুদিন থাকতে পারে। ► ডেঙ্গুর মতো প্লাটিলেট কমে না এবং রক্তক্ষরণ হয় না বিধায় মৃত্যুঝুঁকিও কম থাকে।

করণীয় বা চিকিৎসা
► রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে এবং প্রচুর পানি, ফলের জুস বা অন্যান্য তরল খেতে দিতে হবে। ► চিকুনগুনিয়া হলে বাড়িতেই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। এই রোগের নির্ধারিত কোনো চিকিৎসা নেই। ► সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট হিসেবে প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধই যথেষ্ট। এতে জ্বরের পাশাপাশি ব্যথাও কমে যায়। ► ব্যথা বেশি হলে এনএসএইড ছাড়া সাময়িকভাবে ট্রামাডল গ্রুপের ওষুধ দেওয়া যেতে পারে। ► এডিস মশার কামড়ে চিকুনগুনিয়া হয় বলে এ থেকে বাঁচতে এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস ও মশা নির্মূল করা উচিত।

দরকার ব্যাপক সচেতনতা
এটা আশার কথা যে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমে আসছে। কিন্তু মানুষকে সচেতন করার কাজটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষে আমরা করে যাচ্ছি। কভিড, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদি রোগের বিস্তার রোধে সবাইকে দারুণভাবে সচেতন হতে হবে। গত জানুয়ারি মাস থেকে আমরা বছরব্যাপী স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। পাঁচ বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রস্তুত করে এরই মধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

জনগণের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততায় ক্রমান্বয়ে এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি কম পাওয়া যাচ্ছে। মানুষও আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। আমরা একটা অ্যাপের মাধ্যমে এডিস মশার লার্ভার উৎপত্তিস্থল সংরক্ষণ এবং সময় সময় পর্যবেক্ষণ করছি। এ ক্ষেত্রে অবহেলা হলে আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

এসব সচেতনতার কাজটিতে বিভিন্ন মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা অগ্রগণ্য। আশা করছি জনগণের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় সিটি করপোরেশনের নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সফলতা অর্জন সম্ভব হবে।

scroll to top