ফাইল ছবি। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
নিজস্ব প্রতিবেদক ::
খ্যাতনামা আইনজীবী, দেশ সেরা পার্লামেন্টারিয়ান, সাবেক উপরাষ্ট্রপতি ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আমাদের মাঝে আর নাই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বালাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ্য ছিলেন। রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ হ্রাস, বুকে ব্যথা অনুভব করলে গতবছরেষ ২৯ ডিসেম্বর মওদুদকে ঢাকায় এভার কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি সেখানে ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের অধীনে চিকিৎসা নেন। সেখানে তার হার্টে ব্লক ধরা পড়ায় তার হৃদযন্ত্রে স্থায়ী পেসমেকার বসানো হয়। ১৩ জানুয়ারি সিসিইউ থেকে তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। ২০ জানুয়ারি হাসপাতাল থেকে বাসায় নেওয়া হয়। এরপর আবার ২১ জানুয়ারি তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ২ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টায় সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে তিনি দেশ ছাড়েন। সেখানে দীর্ঘদিন আইসোলেশনে থেকে পরে এলিজাবেথে চিকিৎসা নেন।
আইন পেশার বাহিরে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ-এর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন রয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিবসহ বিএনপির ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। বিএনপি-জাতীয় পার্টি ও আবারো বিএনপির সাথে টানা ১৮ বছর বাংলাদেশের ক্ষমতাধর মানুষ ছিলেন। সাবেক উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ হাফডজন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। একনেক চেয়ারম্যান ও সাংসদ নেতার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদারর শাসনামলে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ অত্যান্ত দাপটে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে পালন করেছেন। তবে এরশাদ সরকর তাঁকে সর্বোচ্ছ সম্মান দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতি করেন।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ-এর মংক্ষিপ্ত জীবনী
মওদুদ আহমদ ১৯৪০ সালের ২৪ মে নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সিরাজপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম মওলানা মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন কলিকাতা আলীগড় মাদ্রাসা ও ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার শিক্ষক। মাতা আম্বিয়া খাতুন। ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ। মওদুদ আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান পাস করে বৃটেনের লন্ডনের লিঙ্কন্স্ ইন থেকে অর্জন করেন বার-অ্যাট-ল। দেশে ফিরে হাইকোর্টে ওকালতির একপর্যায়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন আইনি লড়াইয়ে। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আইনি লড়াই করতে খ্যাতনামা বৃটিশ আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসিকে বাংলাদেশে আনতে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। সর্বশেষে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবী ছিলেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি প্রবাসী সরকারের পোস্ট মাস্টার জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর এপিএস (রাজনৈতিক) ছিলেন ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আইন পেশায় পরিপূর্ণভাবে নিজেকে জড়িয়ে নিলেও রাজনীতি থেকে কখনো দুরে যাননি। দেশ পরিচালনা এবং নেতৃত্বদানের বিভিন্ন সুযোগ তাঁর জীবনে আসে। তিনি সেসব আহ্বানে যথাসময়ে যথাযথ ভাবে সাড়া দিয়ে দেশ ও জাতির প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধ এবং মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি এলাকার উন্নয়নে জীবনের বেশিরভাগ সময় সরকারি দল করেছেন।
১৯৭৭-৭৮ সালে জনাব মওদুদ ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি নোয়াখালী ৫ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯-৮০ সালে তাকে বিদ্যুৎ পানিসম্পদ ও বন্য নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে উপ-প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। এ সময় তিনি সংসদের উপ নেতা নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৮৬-৮৮ সালে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে উপ-প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৮৮ সালে মওদুদ আহমদ ৩য়বার সাংসদ নির্বাচিত হন এবং একই সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করে নোয়াখালীর গৌরব বৃদ্ধি করেন। ১৯৮৮-৮৯ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সংসদ নেতা। ১৯৮৯-৯০ সালে এরশাদ তাকে উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়োগ প্রদান করেন। জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন তিন সরকারের আমলেই ছিলেন ক্ষমতার নিউক্লিয়ার্সে। জীবনের বেশিরভাগ সময়ে তিনি স্বৈরশাসকদের দল করেছেন। পরবর্তীতে ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে তিনি নিজ এলাকায় পরাজিত হয়ে বগুড়াতে উপনির্বাচনে ৬ষ্ঠবার এমপি হন।
বৃহত্তর নোয়াখালীর কৃতি সন্তান ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের রচয়িতা। ১৯৭৯ সালে সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি এবং ঢাকার ইউনিভার্সিটি প্রেস লি. এর যৌথ উদ্যোগে প্রকাশ করে ‘দ্যা এ্্যরা অব শেখ মুজিব’ বাংলাদেশ এবং শেখ মুজিবুর রহমান গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯৯৫ সালে ঢাকার ইউনিভার্সিটি প্রেস লিঃ প্রকাশ করে ডেমোক্রেসী এন্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট এ স্টাডি অব পলিটিক্স এন্ড মিলিটারী ইন্টারভেনশনস ইন বাংলাদেশ। এসব গ্রন্থ মূল্যবান গ্রন্থ অত্যন্ত সুলিখিত ও সুচিন্তিত। এসব গ্রন্থ দেশ বিদেশের পাঠকদের কাছেও সমাদৃত হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব হাইডেলবার্গ জনাব মওদুদ আহমদকে ১৯৭৬, ১৯৮০ এবং ১৯৯৬ সালে ফেলোশীপ প্রদান করে। ১৯৮০-৮১ সালে ফেলোশীপ প্রদান করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার পর ইন্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়ার্স। এ ছাড়া অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন এলিজাবেথ হাইজ তাঁকে ফেলোশীপ দেয় ১৯৯৩ সালে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের জ্যৈষ্ঠ কন্যা হাসনা জসীমউদ্দীনের সাথে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। তার স্ত্রী হাসনা জসীমউদ্দীন মওদুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের সাবেক অধ্যাপক ও সাবেক এমপি। বর্তমানে তিনি এক কন্যাসন্তানের জনক। ছেলে আসিফ ও আমান দুজনই মারা যান। আমান মওদুদ ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়ে পুলিশি নির্যাতনের পর ঠাঁই হয়েছিল কারাগারে। এই ঘটনা মনের অজান্তেই তাকে করে তোলে রাজনীতি সচেতন। ঢাকা কলেজ ছাত্রসংসদের আপ্যায়ন সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অ্যাডভোকেট ফরমান উল্লাহ খান প্রতিষ্ঠিত খেলাফত রব্বানীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশক্তির নেতা ছিলেন। পেশাজীবী হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে নানা ভূমিকায় নিজেকে রেখেছিলেন রাজনীতির কক্ষপথেই। বিএনপি আর জাতীয় পার্টি গঠন ও ভাঙনে পালন করেছেন মুখ্য ভূমিকা। কারাভোগ করেছেন পাকিস্তান আমল, বঙ্গবন্ধু, এরশাদ, ওয়ান ইলেভেন ও মহাজোট সরকারের আমলে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে বিরল সম্মানের অধিকারী হন। উপমহাদেশের কোনো রাজনীতিবিদকে এ পর্যন্ত এই চেয়ারে সম্মানিত করা হয়নি। ভিজিটিং প্রফেসরের মর্যাদা দেয়া হয়নি। ব্যারিস্টার মওদুদের এই দুর্লভ সম্মানে গর্বিত, গৌরবান্বিত দেশ।