বিশেষ প্রতিবেদক :
২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেলের এই প্রকল্পটিকে আট ভাগে ভাগ করে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রতিটি ভাগের কাজের ঠিকাদার আলাদা। তাদের কাজের তদারকি করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এদের বেশিরভাগই জাপানের নাগরিক। প্রকল্পের অর্থায়নকারীও জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা। করোনা পরিস্থিতির কারণে জাপানের সব নাগরিকই দেশে চলে গেছেন। বর্তমানে তাদের অনেকেই ফিরতে পারেননি, যে কারণে কাজের গতি কমেছে।
প্রকল্প সূত্র জানা গেছে, এখন পর্যন্ত পুরো কাজের সামগ্রিক অগ্রগতি হয়েছে ৪৬ দশমিক ১৩ শতাংশ। এরমধ্যে প্রথম পর্যায়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের পূর্ত কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৭৪ দশমিক ১০ শতাংশ। দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মাণের জন্য আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের পূর্ত কাজের অগ্রগতি ৪০ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ইলেক্ট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম এবং রোলিং স্টক (রেলকোচ) ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ কাজের সমন্বিত অগ্রগতি ৩১ দশমিক ১১ শতাংশ। প্রকল্পটি মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত আরও এক দশমিক ১৬ কিলোমিটার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে।
করোনাভাইরাসের কারণে সরকারের অগ্রাধিকার মেগা প্রকল্প মেট্রোরেলের নির্মাণকাজে ধীরগতি চলছে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট ৬১ জন কর্মকর্তা ও শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এরমধ্যেও স্বল্প পরিসরে কোথাও কোথাও কাজ চালু করা হয়েছে। কাজে যোগ দেওয়ার আগে প্রত্যেক কর্মীর করোনা পরীক্ষা নিশ্চিত করা হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কায় ২৩ শয্যার দুটি ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গত ৩০ জুন পর্যন্ত করোনা পরীক্ষায় এই ৬১ জনের পজিটিভ পাওয়া গেছে বলে জানা যায়।
এদিকে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজে ধীরগতির কারনে এখন বর্ষার মৌসুমে নগরবাসীর দূর্ভোগ বাড়ছে। সড়কে খাদা-খন্দ আর পানি জমার কারনেযানবাহন ও পথচারীদের চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে। ছোট-খাটো যানবহন রাস্তার অজুহাতে দ্বিগুন ভাড়া দাবি করছে। তারপরও নগরবাসী ভবিষ্যতের সুখের কথা ভেবে আজকের কষ্টটা সহ্য করছে। তবে আরো অনেক বেশি সময় লাগলে নগরবাসীর কষ্টের সীমা থাকবে না। এই বিষয়ে সদয় হওয়া উচিত মন্ত্রণালয় ও প্রকল্প কতৃপক্ষ।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ৪ জুন থেকে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন’ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু সম্প্রতি স্টেশন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে সেখানে কাজ বন্ধ রয়েছে। দায়িত্বে থাকা শ্রমিকরা জানান, প্ল্যান্টে মালামাল না থাকায় কাজ আপাতত বন্ধ রয়েছে। এছাড়া দ্বিতীয় ধাপে নির্মাণাধীন আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশের কোথাও কাজ চালু থাকতে দেখা যায়নি। তবে প্রথম অংশ উত্তরার দিয়াবাড়ী এলাকার ডিপোতে স্বল্প পরিসরে কাজ চলছে বলে জানা গেছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনা মহামারির আগে প্রকল্পে প্রায় ১০ হাজারের মতো লোক কাজ করতো। কিন্তু মহামারি দেখা দেওয়ার পর জনবল কমতে শুরু করে। প্রকল্পের উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে কাজ করছে চীন ও থাইল্যান্ডের পরামর্শক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশে কাজ করছেন জাপানিরা। এদের মধ্যে চীন ও থাইল্যান্ডের পরামর্শক ও ঠিকাদার এবং তাদের অধীন দেশীয় কর্মীদের অনেকেই কাজে যোগ দিয়েছেন। উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে কাজ করা জাপানিরা এখনও কাজে যোগ দেননি। তাছাড়া লকডাউনের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। যে কারণে এই অংশের কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। জাপানের কারখানায় তৈরি হওয়া প্রথম মেট্রোরেলের ট্রেন সেট দেশে আনার কথা থাকলেও শিপমেন্ট বন্ধ থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রেনের কাজও জাপানের কারখানায় নির্মাণ শুরু হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতিতে কাজ চালিয়ে রাখার জন্য বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের মাসিক প্রতিবেদনে (জুন) বলা হয়েছে, নির্মাণকাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জনবল যাতে দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান করতে পারে সেজন্য নির্মাণস্থলের কাছে আবাসিক স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পের কাজে নিয়োজিতদের করোনা উৎসর্গ আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষায় প্রথম পর্যায়ে উত্তীর্ণদের নিজস্ব স্যাম্পল কালেকশন সেন্টারের মাধ্যমে স্যাম্পল কালেকশন করে দ্বিতীয় পর্যায়ে করোনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ এলে হোম অথবা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা হয়।
শুধু করোনা নেগেটিভ জনবলকে কাজের জন্য চূড়ান্ত বাছাই করে ১৪ দিনের গ্রুপ কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। গ্রুপ কোয়ারেন্টিন শেষ হলে কাজে যোগদান করেন। চলমান করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রথম পর্যায়ে গাবতলী কন্সট্রাকশন ইয়ার্ডে ১০ শয্যাবিশিষ্ট এবং উত্তরাস্থ পঞ্চবটি কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ১৩ শয্যাবিশিষ্ট ফিল্ড হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে।
মেট্রোরেলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) এমএনএ ছিদ্দিক বলেন, ‘কাজে গতি আনার জন্য আমাদের কর্মীদের করোনা পরীক্ষা করা করে কাজে ফেরানো হচ্ছে। আর জাপানের কারখানায় ট্রেন সেট পুরোপুরি প্রস্তুত রাখা হয়েছে। শিপমেন্ট চালু না হওয়ায় দেশে আনা যাচ্ছে না। সেখানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রেন সেট নির্মাণকাজ চলছে।’
তিনি আরও জানান, মহামারি পরিস্থিতির প্রথম দিন থেকেই স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ সীমিত পরিসরে শুরু করা হয়। পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে কাজের পরিধি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে।