প্রতীকী ছবি
সীমান্ত চৌধুরী ::
কোভিড-১৯ আতঙ্ক কমেছে, নেই সচেতনতার বালাই, বেড়েছে উদাসীনতা। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে মহল্লায় মহল্লায় করোনা সংক্রমণ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম চালু করা উচিত। অর্থাৎ করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে স্থানীয় জনসাধারণকে কাজে লাগাতে হবে। আর সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতে মানুষের মধ্যে যে ভীতি ছিল, তা অনেকটাই কমেছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, ভীতি কমলেও বেড়েছে উদাসীনতা। এর ফল মারাত্মক হতে পারে করোনার প্রকোপ। কারণ, ছয় মাস পরও সংক্রমণের হার কিছুটা কমার দিকে থাকলেও মৃত্যু বড় আকারে কমার লক্ষণ নেই।
তাছাড়া কোভিড পরীক্ষায় জনগণের এখনও আস্তার সংকট আছে। মানুষ পরীক্ষা করাতে চাচ্ছে না। আবার যেহেতূ করোনার কোনো চিকিৎসা নেই সে কারনে রোগীরা হাসপাতাল মুখী না হয়ে বরং পারিবারিক টোটকায় আস্তা রাখছেন।
এখন রোগীদের উপসর্গেও কিছু ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে, সরকারি হাসপাতালে শয্যা খালি থাকলেও বেসরকারি হাসপাতালের শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে। কিছু হাসপাতাল রোগী ফিরিয়েও দিচ্ছে।
করোনার নমুনা পরীক্ষা ও করোনা রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রাজধানীর চারটি সরকারি ও দুটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলেছেন, দেশ থেকে করোনার সংক্রমণ অল্প সময়ের মধ্যে চলে যাবে না। সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ বাড়াতে হবে। এ জন্য নিরবচ্ছিন্ন, সমন্বিত ও স্বচ্ছ তথ্যপ্রবাহও দরকার। অনেক হাসপাতালেই কোভিড-পরবর্তী সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। ঝুঁকিতে বয়স্ক রোগীরাও।
করোনা সংক্রমণের ২৩ দিনের মাথায় ১ এপ্রিল থেকে করোনার নমুনা পরীক্ষা শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। শুরুর দিকে নমুনা দেওয়ার জন্য হাসপাতালটিতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনলাইনের মাধ্যমে সম্ভাব্য রোগীদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করে। বিএসএমএমইউর ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সি সম্প্রতি এক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আগের থেকে করোনা নমুনা দেওয়া লোকের সংখ্যা অনেক কমেছে। আবার আগের থেকে সংগৃহীত নমুনার মধ্যে পজিটিভ হওয়ার হার কমেছে। বর্তমানে সংগৃহীত করোনার নমুনার ১২ ভাগ পজিটিভ আসছে। তবে আগে আমাদের হাসপাতালে করোনার নমুনা দেওয়ার জন্য যে ভিড় ছিল, সেই ভিড় এখন অনেক কম।’
পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালেও করোনার নমুনা দেওয়া লোকের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। গত এপ্রিল থেকে করোনার নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করে মিটফোর্ড হাসপাতাল। তখন প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষ হাজির হতেন। বর্তমানে এই সংখ্যা ১০০-র নিচে। মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী রশিদ-উন-নবী বলেন, সংগৃহীত নমুনার মধ্যে পজিটিভ হওয়ার হার ১০-এর নিচে রয়েছে।
কিন্তু এই কম হার এমন ইঙ্গিত দেয় না যে করোনা দেশ থেকে দ্রুত চলে যাবে, এমনটাই মনে করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন। করোনার সংক্রমণ সহসাই দেশ থেকে চলে যাবে বলে আমার মনে হয় না। দু-একটা দেশে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আমাদের পাশের দেশ ভারতসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় কিন্তু সংক্রমণ বাড়ছে। আমাদের দেশেও সংক্রমণ অব্যাহত আছে। প্রতিদিন মৃত্যুও হচ্ছে। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে মৃত্যুর হার কিছুটা কম।’
৬ সেপ্টেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তির সংখ্যা ৬৪৫। এখন পর্যন্ত এ হাসপাতালে মারা গেছেন ৩৯২ জন। আর বিএসএমএমইউতে এ পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ১২৫ জন। বিএসএমএমইউর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আহমেদ আমিন মিডিয়াকে বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ কিন্তু আছে। মানুষও মারা যাচ্ছে। আমাদের হাসপাতালে ২২৫টি শয্যা আছে। প্রায় সবগুলো শয্যায় করোনা রোগী আছে। ঈদুল আজহার পর হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছে।’
বিএসএমএমইউর শয্যা প্রায় পূর্ণ হলেও ৭ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে কোভিড শয্যাসংখ্যা ১৪ হাজার ৪৭৪। এর মধ্যে রোগী ভর্তি আছে ৩ হাজার ৫৬৩ জন। খালি আছে বাকিগুলো। আর আইসিইউ শয্যার সংখ্যা সাড়ে ৫০০। এর মধ্যে রোগী আছে ৩০৭টিতে।
কোরবানির ঈদের সপ্তাহখানেক পরই শয্যার ওপর চাপ বাড়তে থাকে। দুই সপ্তাহ পর আরও বাড়তে থাকে। এখন কোনো শয্যা খালি নেই।’
বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালের রেসপাইরেটরি মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক রওশন আরা খানম বলেন, ‘আমাদের কাছে রোগী আসার সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে বলে মনে হয় না।’ঈদের পর যেসব রোগী তিনি পেয়েছেন তাঁদের বেশির ভাগ হয় পশুর হাটে গেছেন, নয়তো ঈদের সময় ঘুরতে গেছেন।
করোনা সংক্রমণের ছয় মাসেও মৃত্যুর মিছিল থামছে না। অথচ দেশের বড় একটা জনগোষ্ঠী কোনো প্রকারের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে না। গণপরিবহনগুলোয় (বাস, লঞ্চ, ট্রেন) যাত্রীদের বেশির ভাগ মাস্ক পরেন না, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করেন না। ঢাকাসহ দেশের বড় শপিং মলগুলোয় ক্রেতারা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারি সংস্থাগুলোর যে নজরদারি ছিল, সেটিও এখন একেবারই অনুপস্থিত।
শুরুতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছিল প্রবল। এখন সেটা কেটে গেছে। কমেছে সজাগ থাকার মাত্রা। একটা গা ছাড়া ভাব সর্বত্র দেখছি। এটা আমাদের সবার জন্য মারাত্মক। আমাদের দেশে লক্ষণহীন রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। আমরা যদি সবাই উদাসীন হয়ে যাই, তবে বড় ধরনের বিপদ আসতে পারে। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসটি অনেক দ্রুতগতিতে রূপ পরিবর্তন করছে। বিশ্বে করোনা ভাইরাসের রূপান্তরের হার ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর বাংলাদেশে রূপান্তরের হার ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবরেটরির এক গবেষক দল এ তথ্য জানিয়েছে।