করোনাকালেও চিকিৎসায় চলছে গলাকাটা বাণিজ্য

DD-2.jpg

সীমান্ত চৌধুরী :

মানুষ রোগে-শোকে স্রষ্টার পরে যাকে স্মরণ করে তিনি হলেন ডাক্তার। মানুষের বিশ্বাস চিকিৎসার মাধ্যমে যাবতীয় রোগ থেকে সুস্থ করে তুলতে পারেন ডাক্তার। কিন্তু চিকিৎসার মতো সেবামূলক পেশা আজ সাধারণ মানুষের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। কিছু অসাধু ডাক্তারের হীন, ঘৃণ্য, অমানবিক কর্মকাণ্ডের কারণে প্রায় সব ডাক্তারকে মানুষ ভাবছে কসাই, আর তাদের পরিচালিত প্রাইভেট ক্লিনিকগুলো হচ্ছে কসাইখানা। যেখানে পশু নয়, মানুষের গলা কেটে বা জিম্মি করে অর্থ আদায় করা হয়। মানুষ মারাত্মক অসুস্থ হলে সুস্থ হওয়ার জন্যই ছোটেন হাসপাতালে। কেউ শখ করে হাসপাতালে যান না। সরকারি হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের যে অবস্থা সেখানে সুস্থ মানুষ গেলেই অসুস্থ হয়ে যাবেন বলে থাকেন অনেকে।

আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভঙ্গুর অবস্থা তা করোনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। প্রতিবছর স্বাস্থ্য খাতে বাজেট হয় তা যে মিঠু সিন্ডিকেটের কারণে বাস্তবায়ন হয় না তা আজ প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট। আর স্বাস্থ্য খাতের পরিবর্তনের আরেক অন্তরায় হিসেবে বলা হয় মন্ত্রী-আমলা, ভিআইপিদের বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ। সামান্য ঠাণ্ডা-সর্দি-কাশিতে তারা উড়াল দেন বিদেশে। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বর্তমান করুণ পরিস্থিতির জন্য ডাক্তাররাও কম দায়ী নন বলে অভিযোগ রয়েছে। সে জন্য গড়ে উঠেছে অসংখ্য প্রাইভেট ক্লিনিক। যেগুলোর সঙ্গে চিকিৎসকরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত।

সরকারি হাসপাতালে সুষ্ঠু চিকিৎসা না পাওয়ার শঙ্কায় অনেকে যান ঝকঝকে, চকচকে থাকা প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে। অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন সেখানে আলোর নিচেই অন্ধকার। যখন হাসপাতাল থেকে বের হবেন তখন বুঝতে পারেন কোনো কুয়োর মধ্যে এসে পড়েছেন। বিলের কাগজ হাতে পাওয়ায় মনে হয় তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। নামে-বেনামে বিলের মাধ্যমে টাকার পরিমাণটাই বেড়েছে কিন্তু কাক্সিক্ষত সেবা মেলেনি। অভিযোগ রয়েছে, রোগীকে যে সব সেবা বা ওষুধ দেওয়া হয়নি তারও বিল করা হয়।

তাাই অনেকেই আজ দাবি তুলেছেন রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগীরা কেউই চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে পারবেন না। পেশাজীবীরা যার যার পেশা ভিক্তিক হাসাপাতালে চিকিৎসা নিবেন। চেয়ারম্যান মেয়রসহ স্থানীয় সকল জনপ্রতিনিধি নিজ উপজেলায় চিকিৎসা নিতে হবে। এমপি মন্ত্রীরা নিজ জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হবে এমন আইন করে দিলে নিজের জীবনের জন্য হলোও স্বাস্থ ব্যবস্থার উন্নতির কথা ভাববে আমলা ও জনপ্রতিনিধরা। এতে করে স্বস্থ খাতের যদি উন্নতি হয়।

শুধু তাই নয়, মুমূর্ষু রোগীর জন্য তাৎক্ষণিক প্রয়োজন আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র। সেখানেও চলে প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোর জালিয়াতি। রোগী মারা যাওয়ার পরও রোগীকে আইসিইউতে রেখে বিল বেশি করারও অভিযোগ রয়েছে। এমতাবস্থায় মানুষ চিকিৎসা ছাড়াই মরে যাওয়াটাকেই শ্রেয় মনে করছেন।

করোনা আক্রান্ত হয়ে গত ২৩ মার্চ আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ৩৬ বছর বয়সী সাইফুর। সেরে ওঠার পর ২ জুন ছাড়পত্র দেওয়ার সময় ১ লাখ ৭০ হাজার ৮৭৫ টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয় তাকে। সাইফুরের ছোট ভাই আরিফুর রহমান বলেন, বহু কষ্টে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা জোগাড় করে মঙ্গলবার মধ্যরাতে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন তারা। বেসরকারি এক কোম্পানিতে কর্মরত সাইফুর বলেন, ‘ডেডিকেটেড’ হাসপাতালে কোভিড-১৯ চিকিৎসার খরচ সরকার দিচ্ছে, এটা জেনেই আনোয়ার খান মডার্নে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মঙ্গলবার যে বিল তাকে দেওয়া হয়, তা ছিল তার সাধ্যের বাইরে। তিনি জানান, ভর্তি হওয়ার পর থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত তার রক্তের দুটি পরীক্ষা এবং তিনটি এক্সরে হয়েছে। আর হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করেছে শুধু নাপা ট্যাবলেট।

সাইফুর বলেন, আমার কোনো অক্সিজেনেরও প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু এত টাকা বিল করে দিয়েছে। বিলের কপিতে, ২ জুন পর্যন্ত চিকিৎসকের বিল বাবদ ১৮ হাজার ৭০০ টাকা, হাসপাতালের বিল ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৭০ টাকা, পরীক্ষার বিল ১৯ হাজার ৪৭৫ টাকা, ওষুধের বিল ৫ হাজার টাকা এবং ১২ হাজার ৯০৩ টাকা সার্ভিস চার্জ উল্লেখ করা হয়।

নোয়াখালীর সুবর্ণচরের সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন কর্মকর্তা ডা. মহিন উদ্দীন পারভেজ করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রাজধানীর মালিবাগের প্রশান্তি হাসপাতালে। পরবর্তীতে গত গত ১৮ জুন ভোর ৪টায় তিনি শেষ নিঃশ্বা ত্যাগ করেন। রোগীকে আইসিইউতেও রাখা হয়নি। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইসিইউ বিল, করোনার ওষুধসহ আড়াই লাখ টাকার বিল ধরিয়ে দেয়। স্বজনরা এত টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বজনদের র‌্যাবে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। এমনকি লাশকে আঞ্জুমানে মফিদুলেও দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এমন অভিযোগের সত্যতা জানতে সাংবাদিকরা গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চেয়ে ন্যায্য বিল রেখে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে।

সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে রাজধানীর উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতাল। চুক্তি ভঙ্গ করে করোনা রোগীদের থেকে বিল আদায়, ভুয়া প্রতিবেদন তৈরিসহ নানা অভিযোগে হাসপাতালে গত সোমবার সন্ধ্যায় র‌্যাবের অভিযান পরিচালিত হলে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারোয়ার আলমের ব্রিফিং থেকে জানা যায়, রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তিন ধরনের অভিযোগ ও অপরাধের প্রমাণ পেয়েছেন তারা।

স্বাস্থ্য সচিব মো. আব্দুল মান্নান বলেন, হাসপাতালে যে মানের চিকিৎসা দেওয়া উচিত যথাযথভাবে তা দেওয়া হচ্ছে না, আমি নিজেই তার প্রমাণ। হাসপাতালে রোগী ভর্তি হতে পারছে না, এই সমস্যা বাংলাদেশে প্রকট। গত সোমবার রাজধানীর মহাখালীতে জাতীয় বক্ষব্যাধি এবং শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট পরিদর্শনে গিয়ে এসব কথা বলেন স্বাস্থ্য সচিব।

প্রাইভেট হাসপাতালের এসব কর্মকান্ড সম্পর্কে জানতে চেয়ে চেষ্টা করেেও সাড়া পাওয়া যায়নি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের। উত্তর পাওয়া যায়নি অধিদফতরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক আমিনুল হাসানেরও।

রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে মিডিয়াকে বলেন, কিছু কিছু বিষয়ে সরকারকে অনড় থাকা দরকার। বিশেষ করে চিকিৎসাসেবার নামে বড় বড় অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। দেখা যায়, এসব ক্ষেত্রে সরকারদলীয় লোকজন কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত থাকার কারণে এখানে সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সে কারণে একটা অপরাধের পর যখন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না তখন অপরাধীরা সংগঠিত হয়ে আবার অপরাধ করতে থাকে। করোনার এই মহামারির সময়ে চিকিৎসাসেবার নামে যারা এহেন অমানবিক কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে স্বল্প সময়ে শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। তা না হলে এমন অপরাধ আরও বাড়তে থাকবে।

scroll to top