করোনা জালিয়াতির অভিযোগে শাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গতকাল অভিযান চালান র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আবুল হাসনাতকে আটক করা হয়।
দুই কর্মকর্তা আটক, অবৈধ অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে বেশি ফি আদায়, অন্য হাসপাতালে পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট নিজেদের প্যাডে প্রদান
নিজস্ব প্রতিবেদক :
গতকাল রবিবার দুপুরে গুলশান-২-এ অবস্থিত ওই শাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অভিযান চালায় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অবৈধ অ্যান্টিবডি পরীক্ষার কিট, অন্য হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করিয়ে নিজেদের প্যাডে দেওয়া রিপোর্ট, পুরনো সার্জিক্যাল সরঞ্জাম এবং অবৈধভাবে ব্যবহৃত ডিভাইস জব্দ করেন। আটক করা হয় হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মো. আবুল হাসনাত ও হাসপাতালের ইনভেন্টরি অফিসার শাহরিজ কবির সাদিকে।
অভিযান শেষে ভ্রাম্যমাণ আদালত হাসপাতালটির ফার্মেসিতে অননুমোদিত ওষুধ রাখায় দুই লাখ টাকা জরিমানা করেছেন। করোনা পরীক্ষায় অনিয়ম করায় গতকাল রাতেই হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আজ রোগী সরিয়ে হাসপাতালটি সিলগালা করে দেওয়া হবে। নিয়মিত মামলা করার কথাও বলা হয়েছে। এই অভিযানে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, হাসপাতালের চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা মো. শাহাবুদ্দিন। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-অর্থবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর উত্তরের সহসভাপতি ছিলেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন ঢাকা-১০ (রমনা তেজগাঁও) আসনে বিএনপি দলীয় মনোনয়ন পান। গত বছর ১৬ মার্চ অসুস্থতা এবং পারিবারিক কারণ দেখিয়ে দলের সব রকম পদ থেকে সরে যান। মো. শাহাবুদ্দিনের বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জে।
র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্প্রতি শাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার অনুমোদন বাতিল করেছে। কিন্তু তারা অবৈধভাবে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে আসছিল। এই পরীক্ষার নামে রোগীদের কাছ থেকে তিন থেকে ১০ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছিল। অন্য হাসপাতালে পরীক্ষা করিয়ে নিজেদের প্যাডে রিপোর্ট দেওয়া, অবৈধভাবে সরঞ্জাম ব্যবহার এবং একই মাস্ক-গ্লাভস একাধিকবার ব্যবহারের আলামত পেয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দুপুর আড়াইটার দিকে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত গুলশান-২ নম্বরের ১১৩/এ নম্বর সড়কের শাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অভিযান শুরু করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা এই অভিযানে করোনা পরীক্ষায় ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম, উপকরণ, রিপোর্ট ও নথিপত্র যাচাই করেন আদালত। অভিযানে অসহযোগিতা করায় বিকেল ৫টার দিকে ডা. আবুল হাসনাতকে হেফাজতে নেয় র্যাব। এর আগে হাসপাতালের ইনভেন্টরি অফিসার শাহজির কবির সাদিকেও হেফাজতে নেওয়া হয়। হাসপাতালে তল্লাশি চালিয়ে বেশ কিছু র্যাপিড কিট ও রিপোর্ট জব্দ করা হয়। ফার্মেসিতেও ওষুধ যাচাই করেন আদালত। সেখান থেকে ১১ বছর আগের সার্জিক্যাল সরঞ্জাম জব্দ করা হয় বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আদালত পরিচালনাকারী র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাসপাতালটি অনুমোদন ছাড়াই র্যাপিড কিট দিয়ে কভিড-১৯ রোগীদের অ্যান্টিবডি টেস্টের কাজ করছিল। এ ছাড়া তারা অ্যান্টিবডি পরীক্ষার নামে রোগীদের কাছ থেকে তিন থেকে ১০ হাজার টাকা করে নেয় বলে অভিযোগ পেয়েছি।’ তিনি আরো বলেন, হাসপাতালটির বিরুদ্ধে তাঁরা তিনটি অভিযোগ পেয়েছেন। এর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের কভিড-১৯ পরীক্ষার অনুমোদন দিয়েছিল। কিন্তু তাদের স্বয়ংক্রিয় মেশিন না থাকায় এই অনুমোদন বাতিল করা হয়। এর পরও তারা গোপনে পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছিল। তারা বাইরের রোগীদেরও টেস্ট করেছে। এই টেস্টগুলো তারা ডিভাইসের মাধ্যমে করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেই ডিভাইস ব্যবহারের অনুমোদন নেই। আর যেসব রিপোর্ট দিয়েছে তা সবই ভুয়া। দ্বিতীয় অভিযোগ হলো—হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিছু পরীক্ষা বাইরের অন্যান্য হাসপাতাল থেকে করে তা নিজেদের প্যাডে লিখে রোগীদের দিয়েছে। তৃতীয় অভিযোগ হলো—তারা কিছু সামগ্রী যেমন মাস্ক, গ্লাভস এগুলো একের অধিকবার ব্যবহার করছে। এগুলো মূলত একবার ব্যবহারযোগ্য। কিন্তু তারা এগুলো বারবার ব্যবহার করছে।
র্যাবের সূত্র জানিয়েছে, কভিড-১৯ (করোনাভাইরাস) রোগীদের চিকিৎসায় যুক্ত বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মধ্যে অন্যতম ৫০০ শয্যার শাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। সম্প্রতি বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ ওঠে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে। রোগীরা অতিরিক্ত বিল আদায়ের অভিযোগ তুলেছে। বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল অভিযানে যান র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
গতকাল রাতে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ মিডিয়া বলেন, অভিযানে অবৈধভাবে অ্যান্টিবডি টেস্টের রিপোর্ট পাওয়া গেছে। যাচাই-বাছাই শেষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
প্রসঙ্গত, গত ৬ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসায় প্রতারণার ভয়াবহ তথ্য উঠে আসে। এর আগে পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ে জেকেজি নামের একটি প্রতিষ্ঠান করোনা পরীক্ষার নামে জালিয়াতির তথ্য। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের গ্রেপ্তার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।