স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্টিমরোলার চালাতে হবে : হাসানুল হক ইনু

image_264641.inu_.jpg

স্টাফ রিপোর্টার :

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি ও তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতের বড় বড় দুর্নীতিবাজদের ধরে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ দুর্নীতি করার সাহস না পায়। তিনি বলেন, যারা নিম্নমানের ওষুধ সরবরাহ করে, এই ক্রান্তিকালে নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করে তাদের এ কাজ হত্যাকান্ডের চেয়ে বড় অপরাধ। এদের চিহ্নিত করে কঠিন শাস্তি দিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে যে ভয়ঙ্কর দুর্নীতি হচ্ছে তার বিরুদ্ধে একটা কঠিন স্টিমরোলার চালাতে হবে। বুলডোজার চালানো হোক। একই সঙ্গে তিনি বলেন, করোনা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ত্বরিত নির্দেশনা দিলেও তা বাস্তবায়নে বড় বাধা হচ্ছে অদক্ষ, অযোগ্য ও অথর্ব কর্মকর্তারা। এটা কি অদক্ষতা নাকি শেখ হাসিনার সরকারকে সমালোচনার মুখে ফেলে দেওয়ার একটা চক্রান্ত- এটা আমার প্রশ্ন।

স্বাস্থ্য খাতের লাগামহীন দুর্নীতি ও কভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের বিষয়ে গতকাল একটি দেনিকের সঙ্গে আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন হাসানুল হক ইনু। জাসদ সভাপতি বলেন, সরকার ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযান চালিয়েছিল। এই অভিযানের মধ্য দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা বড় পদক্ষেপ নিয়েছিল। স্বাস্ব্য খাতের ভয়ঙ্কর দুর্নীতি বন্ধ করতে এ রকম একটি অভিযান জরুরি। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতকে বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। কেনা-বেচা থেকে শুরু করে সবকিছু স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হবে। যারা স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, যারা মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করে, তদন্তের নামে বিলম্ব না করে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে তাদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠাতে হবে, ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি আশা করেছিলাম, এই সাড়ে তিন মাসে স্বাস্থ্য খাতের যারা দুর্নীতিবাজ, যারা নিম্নমানের ওষুধ সরবরাহ করেছে, নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করেছে তারা দুই চারজন জেলে থাকবে।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের লাল ফিতার দৌরাত্ম্য থেকে স্বাস্থ্য খাতকে উন্মুক্ত করতে হবে। এবারের বাজেটে কভিড-১৯ মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা সুনির্দিষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়নি। এই টাকা কোন কোন খাতে বা কী কী কিনতে ব্যয় করা হবে- সেটা যদি সুনির্দিষ্টভাবে বলে দেওয়া হতো তাহলে দুর্নীতি হতো না। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, যেমন অক্সিজেন সিলিন্ডার, কভিড হাসপাতালের বেড, ওষুধ, সুরক্ষা সামগ্রী বা এ জাতীয় আর যা কিছু আছে সেগুলো এই বরাদ্দ থেকে কেনা হবে, তাহলে থোক বরাদ্দে দুর্নীতি কমে যেত।

সাবেক তথ্যমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা জানার পরও অর্থমন্ত্রী বলেছেন এটি হচ্ছে এক নম্বর অগ্রাধিকার। অথচ এর খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার জন্য যে বরাদ্দ দেওয়া দরকার ছিল সেটা দেননি। ২০২৫ সালের মধ্যে জিডিপিতে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ৫ শতাংশ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এবার ২ শতাংশও বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।

স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির প্রসঙ্গে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু কভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেন, যাদের দিয়ে যে কাজ করা দরকার তাকে দিয়ে সেই কাজ করানো হচ্ছে না। তিনি বলেন, ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী মারা যায়। ৮ মার্চ পর্যন্ত ১২৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। জানুয়ারি মাসে প্রথম নমুনা পরীক্ষা হয়। আর এখন ১৭/১৮ হাজার পরীক্ষা করা হচ্ছে। আগে আইইডিসিআর একা পরীক্ষা করত। এখন ৫৫/৫৬টি ল্যাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রথম মৃত্যুর সাড়ে তিন মাস পর এখন দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটিই বেড়েই যাচ্ছে। কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, সরকার সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত দুই মাসের বেশি সময় সাধারণ ছুটি দিয়েছে। তার আড়ালে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে লকডাউনও ঘোষণা করেছে। অর্থনীতিতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদের জন্য লক্ষাধিক টাকার প্রণোদনা প্রধানমন্ত্রী ঘোষণাও দিয়েছে।

জাসদ সভাপতি বলেন, এই সাড়ে তিন মাসে করোনা রোগী কী, এই শত্রু কী, সেটা আমাদের জানা। এই শত্রুকে কীভাবে আটকাতে হবে, তার কৌশল অর্থাৎ সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব, সেটিও আমাদের জানা এবং করোনা রোগীদের চিকিৎসা পদ্ধতি কী, সেটিও আমাদের জানা। করোনা মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় আমাদের জানা থাকার পরও সাড়ে ৩ মাসে কেন সংক্রমণটা বেড়ে গেল? এর জন্য দায়ী কে?

আমার প্রশ্ন- এই সাড়ে তিন মাস পর সংক্রমণ কমল না, মৃত্যু কমল না, অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হলো, সব কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হলো। কেন?

হাসানুল হক ইনু বলেন, প্রবাসীদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা নিয়ে গোলযোগ, টেস্টিংয়ের আওতা বাড়ানো নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা, কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং অব্যাহত না রাখা, হাসপাতাল প্রস্তুত করতে বিলম্ব, জনবল নিয়োগে বিলম্ব, সম্মুখযোদ্ধা চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ, মাঠ প্রশাসন, সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত না করা, সুরক্ষা সামগ্রীর মান নিশ্চিত না করা, চিকিৎসকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ঘাটতি দূর না করা, কভিড-১৯, নন-কভিড রোগীদের চিকিৎসায় সমন্বয়হীনতাসহ এ রকম অনেক অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতা দেখা গেছে।

জাসদ সভাপতি বলেন, এই যুদ্ধটায় নেতৃত্ব দেওয়া উচিত ছিল নিপসম (NIPSOM) এর। এটা আইইডিসিআর এর কাজ না। তারা গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, এই মহামারী মোকাবিলায় সারা বিশ্ব অপ্রস্তুত ছিল, আমরাও ছিলাম। কিন্তু সারা দেশে সাড়ে ৫০০ উপজেলা হাসপাতাল, সাড়ে ১২ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক, জেলা সদর হাসপাতাল ও অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল ছিল। ৭০ হাজার প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও পাঁচ লাখের বেশি স্বাস্থ্যকর্মী আছে। এগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য দরকার ছিল ত্বরিত পদক্ষেপ, দক্ষতা ও সমন্বয় সাধন।

সাবেক তথ্যমন্ত্রী মনে করেন, সরকার এখন লাল, হলুদ, সবুজ অঞ্চল ভাগ করার কথা বলছে। কিন্তু ৩১ মে থেকে সারা দেশে সব কিছু খুলে দিয়ে এখন বলছে। অথচ আরও ১৫ দিন অপেক্ষা করে অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করে তারপর সব কিছু খুলে দিলে কাজ হতো। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো।

তিনি বলেন, এখন প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা। জনস্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়ে ১০ থেকে ১৫ জনের এক একটি টিম গঠন করা। যারা লাল ও হলুদ এলাকায় গিয়ে রোগী শনাক্ত, তাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া, হাসপাতালে পাঠানো, যাদের আইসোলেশনে পাঠানো দরকার তাদের আইসোলেশনে পাঠিয়ে দেওয়া। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কমিটি এই টিমদের নিয়ে কাজ করবে।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী এখনো এটাকে আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ হিসেবে দেখছেন। এটা তাদের কাজ না। বরং ডিসি, ইউএনও, এসপি এবং ওসিরা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদের নেতৃত্বে কাজ করবে। জোন ভাগ করে অবরুদ্ধ করে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না।

scroll to top