চলমান সময়ে নোয়াখালীর সর্বাধিক জনপ্রিয় সামাজিক ব্যক্তিত্ব ও কৃতিসন্তান সদ্য প্রয়াত খন্দকার লুৎফুর রহমান ফটিক ও কিছু প্রিয় অপ্রিয় কথা

41768509_294888547993518_8967705445611339776_n.jpg

মকছুদের রহমান মানিক
চলমান সময়ে নোয়াখালীর সর্বাধিক জনপ্রিয় সামাজিক ব্যক্তিত্ব ও কৃতিসন্তান সদ্য প্রয়াত লুৎফুর রহমান ফটিক। আশির দশকে জাসদ রাজনীতির উর্বরভূমী বৃহত্তর নোয়াখালীর রাজনৈতিক কেন্দ্র ও বাণিজ্যিক শহর চৌমুহনী তথা চৌমুহনী এস এ কলেজ থেকে পুজিবাদী ঘুনেধরা সমাজের পরিবর্তনের লক্ষে প্রগতির চাকাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দীক্ষা নিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগে কর্মী হন (তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বলতে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগকে বোঝাত, এছাড়াও আরো দুটো ছাত্রলীগ ছিলো একটা মুজিববাদী ছাত্রলীগ অরেকটা বাকশাল ছাত্রলীগ)। সে সময়ে মোগজ ধোলাই হয় মানুষ হতে হলে মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। আধনিক রাজনীতির পাঠশালার সাবেক এ ছাত্রনেতা নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় ধীরে ধীরে ঢাকাস্থ বেগমগঞ্জবাসীর প্রিয় মুখ হয়ে উঠেন। মাঝখানে কিছুদিন বেঙ্গলের মোর্শেদ সাহেবের সঙ্গী হয়ে জাতীয় পার্টি করেন। পরে গ্লোবের কিরন সাহেবের টানে আওয়ামী ঘরনার রাজনীতিতে সক্রীয় হন। সরকারী চাকুরীতে যোগ দিয়ে সড়ক ভবনের সিবিএ নেতা হন। জাসদের সে ফটিক পরে নোয়াখালীর সবার প্রিয়মুখ হয়ে উঠেন। বনে যান মানবতার ফেরিওয়ালা।


আমি একই রাজনীতি করার কারনে ছাত্ররাজনীতির শুরু থেকেই ফটিকের সাথে আমার সুসম্পর্ক। আমিও তখন মুজিব কলেজ ছাত্রলীগের সেক্রেটারী। সে সময়ে আমাদের জেলা রাজনীতির মূল কর্মকান্ড হতো চৌমুহনীকেই কেন্দ্র করে। সে সুবাদে আমরা পরিচিত হয়। শুধু ফটিক নয়, আশির দশকের কমবেশী ২/৩ শতাধিক নেতা আমাকে চিনতেন। আমি তাত্মিক রাজনীতি ও সাহিত্যে দখল থাকার কারনে দলের পোস্টার, লিপলেট, স্যুভিনরসহ প্রায় সকল কাজই আমি করতাম। ফলে প্রতি সাপ্তাহে ২/৩ বার আমাকে চৌমুহনী যেতে হতো। সে সময়ে কলেজের ডিগ্রী হোস্টেল ও চৌরঙ্গী হোটেল আমাদের আড্ডা ছিলো।
মানবতার ফেরিওয়ালা খ্যাত লুৎফর রহমান ফটিক গত ৩ জুন ২০২০ রাত আনুমানিক সাড়ে আটটায় ঢাকার গ্রীন লাইফ হাসপাতালে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নোয়াখালীর সেরা সংগঠক, সামাজিক ব্যক্তিত্ব মানবতার ফেরিওয়ালা লুৎফর রহমান ফটিক-এর মৃত্যুতে ঢাকাস্থ বৃহত্তর নোয়াখালীবাসীর চোখে-মুখে ও হৃদয়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। বাক রুদ্ধ হয়ে যান ফটিকের সামাজিক আত্মীয়রা। করোনার এ দূর্যোগেও সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম করোনাকে ছাপিয়ে ফটিকের ছবি আর শোকনামায় পরিণত হয়। গভীর শোক প্রকাশ করে এবং তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে পরিবার, বন্ধু, তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মী ও সংগঠনের সাথে যুক্ত সবাইর প্রতি সমবেদনা জানাতে থাকে।
বৃহত্তর নোয়াখালীর মানুষের বিপদ-আপদে কাছে থাকা, সাহায্য সহযোগীতা করা, চাকরি-বাকরি দেওয়া, যুব সমাজকে সংগঠিত করা, মানুষের সাথে সদা সর্বদা ভালো ব্যবহার করা, অহংকারমুক্ত জীবনযাপন করা, মানুষের সাথে মেশা ও মানুষের জন্য কিছু করার যে উদারতা একমাত্র ফটিক থেকে নোয়াখালীর মানুষ লক্ষ্য করেছে।
ফটিকের অকাল মৃত্যু নোয়াখালীবাসীর অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো। এ অভাব কখনোই পূরণ হবে না। তবে নোয়াখালীর মানুষের হৃদয় থেকে কখনোই হারাবে না খন্দকার লুৎফুর রহমান ফটিক।


চলমান করোনা দূর্যোগে মানুষ যখন ঘর বন্ধী, সে সময়ও ফটিক নোয়াখালীর কর্মহীন মানুষের আহারের ব্যবস্থা করতে মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটেছেন। বিশ লক্ষ টাকার খাদ্য সামগ্রী দুই হাজার পরিবারে প্রদানের জন্য নোয়াখালীর ডিসির হাতে হস্তান্তর করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নোয়াখালীর ডিসি ফটিকের মানবতা ও উদারতার কথা লিখেছেন।
১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে স্থায়ীভাবে আমি ঢাকায় আসি। শিক্ষাপত্র নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যোগ দিই। আমার অফিস সেগুনবাগিচা। বিকেলে প্রেসক্লাব ও ক্যাফেঝিল মৃগয়া হোটেল পাড়ায় আড্ডা হতো। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে হোটেল পাড়ায় ফটিকের সাথে দেখা হয়। দেখে মনটা ভরে উঠলো। প্রায় প্রতিদিন দেখা হতো। ফটিকের গণসম্পৃক্ততা পরোপকারী মনোভাব আমাকে অবাক করতে লাগলো। ফটিক সড়ক ভবনের অফিস শেষে প্রতিদিনই অনেক রাত পর্যন্ত প্রেসক্লাবের সামনের রেস্তোরাগুলোতে আড্ডা দিতো। আর বৃহত্তর নোয়াখালীর কর্মজীবি ব্যবসায়ী মানুষগুলো সেই আড্ডায় যোগ দিতেন। এর ভিতরেই অনেক বড় বড় অসাধ্য সাধন হতো। কারো ব্যক্তিগত সমস্যা, কারো চাকরি চাই, কারো সাহায্য, কারো মেয়ের বিয়ে, কারো ছেলের লেখাপড়া ইত্যাদি নানান তদবির আসতো ফটিকের কাছে। ফটিকও বিরতীহীনভাবে হাসি মুখে সমাদানের চেষ্টা করছে।
বৃহত্তর নোয়াখালীর বড় ব্যবসায়ী থেকে ক্ষুদ্র পান দোকানী পর্যন্ত ফটিকে এক নামে চেনেন। আর এই চেনা সুবাধে তিনি খুব সহজেই বড়লোকদের কাছে গরীবদের রেফার করতেন। তার রেফারেন্সে ব্যবসায়ীরাও কাউকে ফেরাতেন না। কারণ সবাই ফটিককে বিশ্বাস করতেন, ভালোবাসতেন। মাঝখানে কিছুদিন আমি চাকুরী ব্যবসা ও পারিবারিক জটিলতায় প্রেসক্লাবের হোটেলপাড়া ছাড়ি।
নোয়াখালীর মানুষদের সামাজিক বন্ধন তৈরি করতে ফটিক ২০০১ সালে প্রথম নোয়াখালী উৎসব আয়োজন করে। ঢাবির পুষ্টিবিজ্ঞানের শিক্ষক ডাঃ জাহের ভাইকে আহ্বায়ক এবং নোয়াখালীর ৯ থানার ৯ জন যুগ্ম আহ্বায়ক। আমি কোম্পানীগঞ্জের পক্ষে যুগ্ম আহ্বায়ক এবং স্মরণিকা কমিটির সদস্য সচিব ছিলাম। ২০০১ সালের উৎসবে আমরা অনেকেই কাজ করলেও মূল ভূমিকা ছিলো ফটিকের। আমাদের সে সফলতার পর ২০০৩ সালে আমার বড় ভাই ঢাবির সাবেক ছাত্রনেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেন স্বপনকে আহ্বায়ক করে বিশাল পরিমন্ডলের আযোজন হয়। কিন্তু ওবায়দুল কাদেরসহ নোয়াখালীর আওয়ামী ঘরণার মানুষদের গেস্ট করার কারনে তৎকালীন মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ উৎসব বাতিল করে দেন।
বৃহত্তর নোয়াখালী সমিতি থেকে বের হয়ে ১৯৮৬ সালে নোয়াখালী জেলা সমিতি ঢাকার যাত্রা শুরু হলেও ২০১২ সাল পর্যন্ত নোয়াখালী সমিতি ছিলো গুটি কয়েকজনের গোল টেবিল সমিতি। হাতেগনা কয়েকজন কমিটি রিনিউ করে পদপদবী ভাগাভাগি করে নামের খসম সমিতি চলে। ফটিক নোয়াখালী সমিতিতে ডুকে কাছের কিছু লোককে নিয়ে ২০১৫ সালে অর্ধলক্ষাধিক লোকের নোয়াখালী উৎসব করে ঢাকাস্থ নোয়াখালীবাসীকে জানান দেন এবং লাইফ মেম্বারদের টাকায় সমিতির স্থায়ী অফিস হয়।


২০১৫ সালে সমিতির কার্যকরি কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও উৎসবের উচিলায় নির্বাচন না করে সভাপতি নিজেরাই নিজেদের মেয়াদ বাড়িয়ে নেন। পরে কমিটি রিনিউর কথা আসলে ফটিক বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। ফটিক অনুরোধ করে ওপেন নির্বাচন। এখন সমিতির ১৮০০ শত লাইফ মেম্বার আছে। এর মধ্যে অনেক শিল্পপতি আছে। নির্বাচনে যারা আসবেন তার সমিতির নিজস্ব ভবন করবেন। নোয়াখালীর শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু উচ্চবিলাসী কিছু কর্মকর্ত সমিতিতে আঁকড়ে ধরে রাখতে চান। সমিতির সহস্রাধিক লাইফ মেম্বার পরিষদ করে ফটিকের পাশে দাঁড়ায়।
কিন্তু চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী। অবশেষে লাইফ মেম্বারদের অগোচরে আবারো ক্ষমতা কুক্ষিগত। এমনকি ফটিককে সামাজিক মোড়ল বলে অপবাদ দিতেও তাদের লজ্জা করেনি। অথচ এরা ফটিকের গড়া চুনোপুটি। সমিতির বিরোধে ফটিককে কোনঠাসা করতে তাঁর পেটে লাতি মারারও এরা চেষ্টা করেছে। ফটিকের সরকারি চাকুরীর দপ্তরে নানা অভিযোগ করেছে। ফটিক সিবিএর নেতা না হলে তার চাকুরী থাকতো না। যাদের জন্য ফটিক এতো কিছু করলো তারা তাকে পদে বসাতে চেষ্টা করার আগে দুবার ভাবলো না। এটাই নিয়তি, এটাই বাস্তবতা।
নোয়াখালীর সেরা সংগঠক, সামাজিক ব্যক্তিত্ব মানবতার ফেরিওয়ালা লুৎফর রহমান ফটিক-এর মৃত্যুতে বৃহত্তর নোয়াখালীবাসীর হৃদয়ে শোকের ছায়ায় যখন আকাশ বাতাস মাটি ভারি হয়ে আসে তখন এরাও লৌকিকতা করতে সামাজিক মাধ্যমে শোকবার্তা দেয়। আমার সন্দেহ হয় এরা আসলে শোকাহত নাকি বাঁধা কেটে গেছে সে ভেবে মনে মনে আনন্দ কলা খাচ্ছে।


আমি আজ বাক রুদ্ধ। আমার ৪০ বছরের বন্ধু আত্মার আত্মীয় ফটিকের জন্য। আমি ভাবতে পারছিনা আর কোনদিন ফটিকের সাথে দেখা হবে না। করোনা যুদ্ধে হেরে গিয়ে মহান আল্লাহর ডাকে ফটিক পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। আর ফটিক আমার কাছে আসবে না। বলবে না মানিক ভাই এটা লিখে দেন। এটা কিভাবে করবো। সাম্প্রতিক সময়ে আমি ফটিক আর এসি সেলিম, ছালাউদ্দিন, পারভেজ খুব কাছাকাছি ছিলাম। আর বিকাল হলে ফটিক ফোন দিবে না। বলবে না একটু নোয়াখালী ক্লাবে আসেন। আজ ফটিক নেই। নিঃসন্দেহে খন্দকার লুৎফুর রহমান ফটিক একজন ভালো মানুষ ছিলেন। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন। আমীন।
(আমার লেখাতে কেউ মনে কষ্ট পেলে আমি দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী, দয়া করে আমাকে মাপ করবেন)

scroll to top