বিশেষ প্রতিবেদক :
স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম কারিগর শাজাহান সিরাজ। ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে লড়াকু যোদ্ধা হিসেবে। সমাজবিপ্লবের স্বপ্ন দেখা এই তুখোড় রাজনীতিক শেষ জীবনে বাম আদর্শের বিপরীতে হেঁটে বিএনপিতে ঠাঁই নিলেও জাসদ নেতা হিসেবেই মানুষ চেনে তাঁকে। রাজনৈতিক জীবনের শেষ ভাগে মন্ত্রী হিসেবে তিনি পরিবেশবিধ্বংসী পলিথিন নিষিদ্ধ করে পরিবেশ রক্ষার যোদ্ধা হিসেবে যেমন পরিচিতি পেয়েছেন, তেমনি বিএনপি-জামায়াতের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে ছিলেন বিতর্কিত।
শাজাহান সিরাজের জন্ম ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে। হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে ছাত্ররাজনীতির হাতেখড়ি। সেই সময় তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত কলেজের ছাত্র এবং দুই মেয়াদে কলেজের ছাত্রসংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। একজন সক্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি ষাটের দশকে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেন।
১৯৭০-৭২ মেয়াদে অবিভক্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শাজাহান সিরাজ। তখন ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) আ স ম আবদুর রব ও জিএস আবদুল কুদ্দুস মাখনের সঙ্গে তিনি ছিলেন ‘চার খলিফা’র একজন। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন তাঁরা। স্বাধীনতার উত্তাল আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে আয়োজিত ছাত্র সমাবেশে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতার পর রব-সিরাজের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের ভাঙন থেকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হলে সেই দলের সহসাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন শাজাহান সিরাজ। জাসদ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। তখন শাজাহান সিরাজকে কিছুদিন কারাগারে থাকতে হয়। পরে জাসদ ভাঙতে ভাঙতে কয়েকটি ভাগ হলে একটি অংশের সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব ধরে রাখেন শাজাহান সিরাজ। তাঁর নেতৃত্বাধীন অংশ জাসদ (সিরাজ) নামে পরিচিত ছিল।
জাসদের মনোনয়নে তিনবার জাতীয় সংসদের টাঙ্গাইল-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শাজাহান সিরাজ। একসময় তৎকালীন স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের সঙ্গে হাত মেলানো নিয়ে রবের সঙ্গে দ্বন্দ্বে আলাদা হয়ে যান শাজাহান সিরাজ। তখন শাজাহান সিরাজের সঙ্গে ছিলেন হাসানুল হক ইনু। কিন্তু এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। ১৯৮৮ সালের ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচনে শাজাহান সিরাজ অংশ নিলে ইনু আলাদা জাসদ গড়েন। তাতে অনেকটা একা হয়ে পড়েন শাজাহান সিরাজ। রাজনীতির পালাবদলের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালে দল নিয়ে বিএনপিতে যোগ দেন শাজাহান সিরাজ। বিএনপির ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। তিনি বিএনপির মনোনয়নেও একবার একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ওই সরকারের শেষ পর্যায়ে নৌপরিবহনমন্ত্রী ছিলেন।
শাজাহান সিরাজ বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হিসেবে পরিবেশ রক্ষায় লড়াকু যোদ্ধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। নিষিদ্ধ করেছিলেন পলিথিনের উৎপাদন ও বিপণন। পলিথিনের বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এর উৎপাদন ও বিপণন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া তিনি রাজধানীতে থ্রি স্ট্রোক ইঞ্জিনের অটোরিকশা নিষিদ্ধ করেন। তাঁর সময়ের প্রধান বন সংরক্ষক ওসমান গণি বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অবৈধ টাকাসহ ধরা পড়েন। এ নিয়ে তিনি বিতর্কিত হন। শাজাহান সিরাজের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আমলে দুর্নীতির মামলা হয়। সূত্র : কালের কন্ঠ।